মাহফুজুর রহমান :
নওয়াপাড়া শহর খুলনা বিভাগের যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার অন্তর্গত একটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভা এবং শিল্প-বাণিজ্য সমৃদ্ধ নগর । এটি খুলনা-যশোর মহাসড়কের খুলনা এবং যশোরের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। ভারী শিল্প-কারখানা এবং নদী-বন্দরের জন্য নওয়াপাড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। ১৯৯৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সর্বমোট ৯টি ওয়ার্ড-এ সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এখানে বসবাস করছেন ৮৫৮৮৬ জন নাগরিক। যদিও বর্তমান এই সংখ্যা লক্ষ ছাড়িয়েছে। খুলনা বিভাগের মধ্যে নওয়াাপাড়া অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। সার,গম ও কয়লা সহ প্রয়োজনীয় অনেক মালামাল নওয়াপাড়ার নদী-বন্দর থেকে খালাস হয়ে সারা দেশে সরবরাহ হয়ে থাকে। সেই হিসেবে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র বলা হয়ে থাকে এই নওয়াপাড়াকে।
এ অঞ্চলের ধর্মীয় গুরুত্বও অনেক । যশোরের প্রসিদ্ধ প্রভাবশালী আলেম মাওলানা আবুল কাসেমের আমন্ত্রণে নওয়াপাড়ায় ইরানী পীর জনাব মোহাম্মদ আলী শাহ ইরানী হযরতের আগমন ঘটে এখানে। সমাজ-সংস্কারক মাওলানা আবুল কাসেম এর হাতে প্রতিষ্ঠিত এ অঞ্চলের প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ” মাদ্রাসায়ে মোহাম্মাদীয়া নওয়াপাড়া” এ অঞ্চলের শিক্ষা ব্যাবস্থা ও ধর্মীয় চেতনায় আমুল পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন। নওয়াপাড়া শহরেই অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপের কার্যালয় এবং তাদের নিজস্ব শিল্প নগর যা “আকিজ সিটি” নামে পরিচিত। এই পৌরসভার এরিয়ায় অন্তত ২৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৮টি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি ডিগ্রী কলেজ সহ ৪টি কলেজ ও ২২টি মাদ্রাসা সহ অসংখ্য মসজিদ-মন্দির রয়েছে।
এত এত সম্ভাবনা এবং ঐতিহ্য থাকার পরও সময়ের পরিক্রমায় নওয়াপাড়ার যে উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিলো সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের সমান নাগরিক সুযোগ-সুবিধাও পৌরবাসী পায়না। এখানকার রাস্তা-ঘাট এর জীর্ণ দশা দেখলে বুঝার উপায় নাই যে এটি একটি পৌরসভার অন্তর্গত রাস্তা। পানি নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় এই পৌরসভার অনেক অঞ্চল এখনো বন্যায় কবলিত থাকে। বিগত বছরে এর ভয়াবহতা আমরা লক্ষ করেছি। পৌরসভার নাগরিক হিসেবে অতিরিক্ত ট্যাক্স পরিশোধ করলেও এখানকার নাগরিকেরা প্রকৃত নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত। রাতে রাস্তা-ঘাটে পর্যাপ্ত আলোর অভাবে চলাচল করা কষ্ট সাধ্য এবং অপরাধীদের জন্য সেটি সুযোগ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সুপেয় পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এখানে নেই।
২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরের জন্য ১০০ কোটি টাকার বেশি বাজেট পাশ করা হয়েছিলো যার মধ্যে উন্নয়ন বাজেটই ছিলো ৮৭ কোটি টাকা। প্রতি বছর এভাবে শত কোটি টাকার বাজেট থাকলেও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার অভাবে অবকাঠামোগত তেমন কোনো উন্নয়ন এখানে সাধিত হয়নি। আবার দূর্নীতি অনিয়মের ফলে কোয়ালিটিফুল উন্নয়ন নগরবাসী পায়নি।
হতভাগ্য আমরা এখানে একজন জনদরদী সমাজসেবক তথা জনতার মেয়র পায়নি। আমাদের সম্মানিত মেয়র সাহেবরা দলীয় গন্ডির বাহিরে যেয়ে সকল নাগরিকের মেয়র হয়ে উঠতে পারেনি। যার ফলে পৌরসভার সাধারণ সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয় এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। বিধবা বয়স্ক সহ সকল ভাতার ক্ষেত্রে সুবিধা পেয়েছেন দলীয় পরিচয়ধারীরা। অথচ যিনি মেয়র হবেন তার হবার কথা ছিলো সার্বজনীন। তিনি মেয়র হওয়ার পর তিনি যে শুধু তার দলের মেয়র নন, তিনি এই ‘জনপদের মেয়র’ এই ছোট কথাটি ধারণ করতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন আমাদের বিগত মেয়রগণ। যার ফলে বঞ্চিত থেকে গেছেন প্রকৃত অসহায়েরা। তারা দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও অনেক সময় তাদের ক্ষুদ্র অধিকারটুকুও পান নাই।
নারী ও শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমরা করতে ব্যর্থ হয়েছি। এখানে নৌ-পথ , রেলপথ ও সড়ক পথের সমন্বয়ে চমৎকার যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। এত এত সুবিধা থাকার পরও নওয়াপাড়ার মুল বাজারে যানজট এখন নিত্য দিনের সঙ্গী। ব্যাবসায়িক অঞ্চল হওয়া সত্বেও মাল বোঝাই ট্রাকের পর্যাপ্ত পার্কিং সুবিধার অভাবে রাস্তার দু-ধারে পার্কিং করার ফলে এখানে সার্বক্ষনিক যানজট পোহাতে হয় এই এলাকাসহ এ-পথে যাতায়াতকারী সকল নাগরিকদের। অথচ সামান্য কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে এই যানজট সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু কে করবেন?
এখানকার ব্যবসায়ীরা বছরে কোটি কোটি টাকা সরকারকে রাজস্ব দিচ্ছে। অথচ ব্যবসায়ীদের সমস্যা সমাধানে আশু কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনা। পথে পথে তাদের ভোগান্তির স্বীকার হতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পাঠদানের সুযোগ এখানে খুবই সীমিত। বিগত কয়েকদিনে এখানকার কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সেখানকার শিক্ষার্থীদের কোয়ালিটি আমাকে যারপরনাই হতাশ করেছে। সমাজের সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য নেই কোনো আলাদা উদ্যোগ। তরুণ ও যুবকদের প্রোডাক্টিভিটি কাজে লাগিয়ে আমরা যে আধুনিক বসবাস উপযোগী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারি সেই উদ্যোগের অভাব।
মাদকের ভয়াবহতা বর্তমানে সীমাহীনভাবে বেড়ে চলেছে। এর লাগাম ধরার যেনো কেউ নেই! আমাদের তরুণ সমাজকে ধ্বংসকারী এই মাদক নির্মূল করতে না পারলে সমাজ থেকে অন্যায়-অনাচার কোনোভাবেই বন্ধ করা সম্ভব নয়। প্রতিটি এলাকায় গড়ে উঠেছে মাদকের অভয়ারণ্য। হাতের নাগালেই পাওয়া যাচ্ছে ভয়ংকর সব মাদক দ্রব্য। অথচ নেই রিহ্যাবিলিটেশন এর কোনো ব্যবস্থা। অথচ দীর্ঘ মেয়াদী পূনর্বাসন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে অনেক যুবককে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
এখন আমাদের দরকার একজন জনতার মেয়র। যিনি কোনো দলীয় মেয়র হবেন না। তিনি নওয়াপাড়া পৌরবাসীর মেয়র হবেন। সকল দল,মত ও ধর্ম নির্বিশেষে সকলকেই ধারণ করবেন। তার কাছে সবাই সমান মর্যাদা পাবেন। তিনি অসহায়ের আশ্রয়স্থল হবেন। পৌর ভবনটি হবে সাধারণ নাগরিকের সমস্যা সমাধানের কেন্দ্র। হাজার কষ্ট নিয়ে এখানকার নাগরিকেরা পৌর ভবনে ঢুকবেন, কিন্তু বের হওয়ার সময় একটি প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বের হবেন। সমাজের সকল স্তরে ইনসাফ কায়েম করা হবে। ‘ইনসাফ ও উন্নয়ন’ এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য দরকার আমাদের একজন জনতার মেয়র।