মোঃ মাসুদুর রহমান শেখ, বেনাপোলঃ
ভালো শিক্ষক মানেই শুধু পাঠদান নয়, তিনি একজন দিকনির্দেশক, অনুপ্রেরণাদাতা ও সমাজ গড়ার কারিগর- এই কথাটির বাস্তব রূপ দেখা যায় যশোর জেলার শার্শা উপজেলার বাগুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মোছাঃ খাদিজা খাতুনের জীবন ও কর্মে।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস-২০২৪ উপলক্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে যশোর জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাকে নির্বাচিত করেছে শিক্ষা বিভাগ। সম্প্রতি বিভাগীয় উপপরিচালক (প্রাথমিক শিক্ষা) খুলনা বিভাগের প্রেরিত নির্দেশনা অনুযায়ী যশোর জেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ আশরাফুল আলম স্বাক্ষরিত তালিকায় তার নাম ঘোষণা করা হয়।
গত ১০ বছর ধরে খাদিজা খাতুন বাগুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং শিশুদের স্বপ্ন দেখার ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার বেড়েছে, শিক্ষার্থীদের ফলাফল উন্নত হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ৪২ বছর পর বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথমবারের মতো বৃত্তি অর্জন করতে শুরু করেছে। এমনকি তার নিজের ছেলেমেয়েদের দিয়েই সেই বৃত্তির যাত্রা শুরু হয়েছিলো। একইসাথে স্থানীয় অভিভাবকদের মধ্যেও শিক্ষার প্রতি সচেতনতা তৈরি হয়েছে।
স্থানীয়রা বলেন, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢুকলেই চোখে পড়ে পরিপাটি পরিবেশ, খেলায়-গানে মগ্ন শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি। তাদের চোখে ভরসা, কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস। আর এই পরিবেশ তৈরির নেপথ্যে আছেন নিবেদিতপ্রাণ এই প্রধান শিক্ষিকা।
এ বিষয়ে মোছাঃ খাদিজা খাতুন বলেন, “বিদ্যালয়টা যখন হাতে পাই, তখন যেন ভেঙে পড়া এক ঘর। আমার স্কুলটি খুবই অবহেলিত ও জরাজীর্ণ হওয়ায় এখানকার ছেলেমেয়েরা পাশের বাঁগআঁচড়া স্কুলে যেত। কোনও শিক্ষক এখানে বেশিদিন থাকতে চাইতেন না। আমি কায়িক পরিশ্রম করেছি, শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছি। আমি যোগদানের পর শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি। প্রতিষ্ঠার ৪২ বছর পর আমার স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা প্রথম বৃত্তি পায়। শিক্ষা দপ্তর আমার এই প্রচেষ্টা মূল্যায়ন করায় এই স্বীকৃতি আমাকে আনন্দিত করেছে। আমি কৃতজ্ঞ। তবে জরাজীর্ণ স্কুল ভবনটি ভেঙ্গে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য সরকার যেন উদ্যোগ নেয়, এটাই এখন আমার বড় প্রত্যাশা। পরিবেশ যদি ভালো হয়, আমি আরও ভালোভাবে সন্তানদের মানুষ গড়তে পারব।
স্থানীয়রা বলেন, তিনি কেবল একজন প্রধান শিক্ষক নন, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন মা, একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। জমজ এক ছেলে ও এক মেয়ের জননী। তার ছেলেমেয়ে এবারের এইচএসসি পরীক্ষা শেষে উন্নত শিক্ষা গ্রহণের জন্য কোচিং করছে। খাদিজা খাতুন নিজের সন্তানদেরও এই স্কুলেই ভর্তি করিয়েছিলেন, যেন তারা অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়। তিনি বাগআঁচড়া এলাকার হেলাল মোঃ আবু রায়হানের স্ত্রী এবং শিক্ষক পরিবারে বেড়ে ওঠা খাদিজা খাতুনের বাবা ও শ্বশুর-উভয়েই শিক্ষক ছিলেন।
শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী নাজিব হাসান উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সহকর্মীরা মনে করেন, এ পুরস্কার কেবল একজন শিক্ষকের স্বীকৃতি নয়, বরং পুরো শিক্ষাক্ষেত্রের জন্য এক অনুপ্রেরণা।
উল্লেখ্য, একইসাথে, যশোর সদরের পাঁচবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা সুলতানা রাজিয়াকে ‘গুণী সহকারী শিক্ষক’ হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল ও আনন্দমুখর শিক্ষার পরিবেশ তৈরিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই স্বীকৃতি কেবল ব্যক্তিগত সম্মানই নয়, বরং জেলার সকল শিক্ষকের জন্য এক উজ্জীবনী শক্তি। স্থানীয়রা মনে করেন, শিক্ষক দিবসে এই সম্মাননা প্রমাণ করে-অবহেলিত গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোতেও আছেন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকরা, যারা নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে গড়ে তুলছেন আগামী দিনের বাংলাদেশ।