
আতিকুর রহমান সাগর:
ভোলা জেলার তেতুলিয়া নদীর কোল ঘেঁষে থাকা চরকলমী ইউনিয়ন যেন শীতের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার এক জীবন্ত চিত্র। এখানে শীতকাল শুধুই ঠান্ডার গল্প নয়, বরং তা জীবনযাত্রার নিত্যনতুন রঙ, সংগ্রাম আর ঐতিহ্যের মেলবন্ধন। কুয়াশা ঢাকা প্রভাত, আগুন পোহানো মুহূর্ত, পিঠা-পুলির আয়োজন—সব মিলিয়ে চরকলমীতে শীত যেন এক মজার ঋতু, যা একই সঙ্গে কষ্টের এবং আনন্দের।
শীতের সময় তেতুলিয়া নদী যেন আরও বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। নদীর পাড়ে দাঁড়ালে মনে হয়, ঠান্ডা বাতাস শরীর ভেদ করে হাড়ে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে। অথচ এখানকার মানুষ সেই বাতাসের সঙ্গেই মিতালি করে। ভোরের দিকে নদীর ধারে গেলে দেখা যায়, জেলেরা কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে জাল নিয়ে মাছ ধরতে ব্যস্ত। তাদের পায়ে কোনো জুতা নেই, কাঁধে পুরনো একটা শাল। ঠান্ডা পানির সঙ্গে তাদের এই লড়াই যেন এক অদ্ভুত দৃশ্য।
শীতকালে চরকলমীর প্রতিটি বাড়িতে ভোরবেলা একটি কমন দৃশ্য দেখা যায়—আগুন পোহানোর আয়োজন। ধান খড় বা শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে সকলে গোল হয়ে বসে। কেউ গল্প করে, কেউ তামাক টানে, কেউবা চুপচাপ বসে হাত গরম করে। এই আড্ডায় উঠে আসে গ্রামের খবর, জমির কথা, নদীর গল্প আর কখনো কখনো পুরোনো দিনের স্মৃতি। শীতকালীন এই আড্ডাগুলো গ্রামীণ জীবনের অন্যতম মজার অংশ।
চরকলমীর শীতের সকালে গরম ভাপা পিঠার গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। গৃহিণীরা খুব ভোরেই উঠেই চুলায় পিঠা বানানো শুরু করেন। পিঠার সঙ্গে থাকে খেজুরের রস। আর খেজুরের রস নিয়ে এখানে যেন একধরনের উৎসব লেগে থাকে। ভোরবেলা তরতাজা রস খেতে সবাই হাটে ছুটে যায়। এই রস থেকে বানানো পায়েস আর গুড় শীতকালের বিশেষ আকর্ষণ।
শীতকালে চরকলমীতে হাট-বাজারে আলাদা এক উৎসবমুখর পরিবেশ থাকে। খেজুর রস, মাটির চুলায় তৈরি চা, মুড়ি-মুড়কি, আর নানা ধরনের পিঠা নিয়ে হাট জমজমাট। শীতের হাট যেন শুধু কেনাকাটার জায়গা নয়, বরং এটা মানুষের মিলনমেলা। বয়স্করা এককোণে বসে ধোঁয়া ওঠা চা হাতে নিয়ে গল্প করেন, আর শিশুরা মেলায় পাওয়া খেলনা নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে।
শীত যেমন আনন্দ নিয়ে আসে, তেমনি এর চ্যালেঞ্জও কম নয়। চরকলমীর অনেক মানুষ শীতের রাতে গায়ে পুরনো কম্বল জড়িয়ে ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করেন। বিশেষ করে শিশু এবং বৃদ্ধদের জন্য শীতকাল বেশ কষ্টদায়ক। চিকিৎসার অভাব এবং প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রের সংকট চরকলমীর বাস্তব চিত্রকে আরও কঠিন করে তোলে।
তবে এই সংগ্রামের মাঝেও চরকলমীর মানুষের হাসি এবং জীবনযাপনের উদ্যম থেমে থাকে না। তাদের ঐতিহ্যবাহী পিঠা, হাটের উৎসব, আর আগুন পোহানোর আড্ডা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির প্রতিকূলতার মধ্যেও কীভাবে আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়।
চরকলমীর মানুষের শীতকালীন জীবন আমাদের শিখিয়ে দেয়, শীত শুধু ঠান্ডা নয়, বরং এটি সংগ্রামের নতুন অধ্যায়, আনন্দের নতুন উপলক্ষ। তেতুলিয়া নদীর হিমেল বাতাসের সঙ্গে তাদের এই মিতালি এবং লড়াই যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির কঠিনতাকে মেনে নিয়েও জীবনে রঙ নিয়ে আসা সম্ভব। শীতকাল এখানে শুধু ঋতু নয়; এটি গল্প, ইতিহাস আর জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।