মাসুদ মাহাতাব,ঢাকা:
শিক্ষা হলো জাতির মেরুদণ্ড—এই প্রবাদ বহুবার আমরা শুনেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি নতুন সংকট প্রকট হয়ে উঠছে, আর তা হলো শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগিতা ও অনাগ্রহ। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা নানা রকম কৌশল অবলম্বন করছেন—কেউ সৃজনশীল পাঠদান করছেন, কেউ দলীয় কাজ করাচ্ছেন, কেউবা ভালো শিক্ষার্থীর সাথে দুর্বল শিক্ষার্থীকে জোড়া করে শেখানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু ফলাফল আশানুরূপ নয়। পাঠ শেষে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। শ্রেণিভিত্তিক অর্জনযোগ্য দক্ষতা অর্জনেও তারা পিছিয়ে পড়ছে। একসময় শ্রেণিকক্ষ ছিল প্রাণবন্ত আলোচনার জায়গা, এখন সেখানে নীরবতা, বিমুখতা ও আত্মভোলা আচরণ।
শিক্ষার্থীদের এই অমনোযোগিতার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার এর মধ্যে অন্যতম। স্মার্টফোন, গেমস, ইউটিউব, টিকটক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শিক্ষার্থীদের মনের জগৎ দখল করে নিচ্ছে। পড়াশোনা হয়ে উঠছে গৌণ। পাশাপাশি পরিবার থেকেও পর্যাপ্ত তদারকি ও প্রেরণা মিলছে না। অনেক অভিভাবক সন্তানের সঙ্গে সময় কাটান না, পড়াশোনার খোঁজখবর নেন না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে একঘেয়ে শিক্ষাদান পদ্ধতি। পরীক্ষার চাপ, প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা, পড়াশোনাকে কেবল নম্বরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখার প্রবণতা শিক্ষার্থীদের মানসিক ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সমাজেও শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমছে, যা শিশু-কিশোরদের মানসিকতায় প্রতিফলিত হচ্ছে।
তবে সমস্যা যত জটিলই হোক, সমাধান অসম্ভব নয়। শিক্ষক, অভিভাবক এবং সমাজ—তিন পক্ষকেই সমান দায়িত্ব নিতে হবে।
•অভিভাবক সমাবেশ ও তদারকি: বিদ্যালয়ে নিয়মিত অভিভাবক সমাবেশ আয়োজন করতে হবে। এতে পরিবার সন্তানের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত হবে এবং শিক্ষকদের সঙ্গে সমন্বয় তৈরি হবে। ঘরে বসে সন্তানের প্রতি মনোযোগী হওয়া অভিভাবকের অন্যতম কর্তব্য।
•আধুনিক ও সৃজনশীল পাঠদান: শিক্ষাদানকে একঘেয়ে বইয়ের ভেতরে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। প্রযুক্তিকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়ে মাল্টিমিডিয়া, প্রজেক্টভিত্তিক শিক্ষা, দলীয় আলোচনা, খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ জাগাতে হবে।
•সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াচর্চা: শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চিত্রাঙ্কন, বিতর্কসহ বিভিন্ন কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বৃদ্ধি করে। এগুলো শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বাড়ায়।
•প্রেরণা ও উৎসাহ: শিক্ষার্থীদের ছোটখাটো সাফল্যকেও গুরুত্ব দিয়ে প্রশংসা করতে হবে। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে এবং পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে।
•সমাজের ভূমিকা: সমাজকে শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাকে মর্যাদাপূর্ণ করে তুলতে পারলেই শিশুদের কাছে এটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষা শুধু তথ্য মুখস্থ করার নাম নয়; এটি হলো চরিত্র গঠন, মনন বিকাশ এবং মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। যদি শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী না হয়, তবে আমরা একটি উদাসীন ও দিশেহারা প্রজন্মের দিকে এগিয়ে যাব। আর সেই প্রজন্ম কোনোভাবেই জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্য হবে না।
এখনই সময় সতর্ক হওয়ার। শিক্ষার্থীদের মনোযোগী করে তুলতে হলে শিক্ষক-অভিভাবক-সমাজকে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষাকে আনন্দমুখর করতে হবে, জীবনঘনিষ্ঠ করতে হবে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়তে হলে আজই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনতে হবে আগ্রহ, একাগ্রতা ও প্রাণশক্তি। নইলে জাতির মেরুদণ্ডে দুর্বলতা দেখা দেবে, যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন হবে।