মাহফুজুর রহমান :
বাংলাদেশের অন্যতম বানিজ্য নগরী অভয়নগরের নওয়াপাড়া। প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার পন্য আমদানি রপ্তানি হয় নওয়াপাড়ার নদী বন্দরের মাধ্যমে। বাংলাদেশের আর্থিক অগ্রগতিতে নওয়াপাড়ার অবদান সীমাহীন। সরকার প্রতি বছরে শতকোটি টাকা রাজস্ব আদায় করছে এই নওয়াপাড়া থেকে। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য এই হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়ের ভেন্যু হিসাবে পরিচিত অভয়নগরের সাধারন মানুষের আর্থিক এবং সামাজিক উন্নতির হার খুবই হতাশাজনক। এখানকার গ্রামের রাস্তাঘাট চলাচলের অনুপযুক্ত। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের নওয়াপাড়া বাজার অংশের অবস্থা খুবই নাজুক। যানজট এখানকার নিত্যদিনের সমস্যায় পরিনত হয়েছে। খানা-খন্দে ভরা মহাসড়ক। উপরের কথাগুলি শুধুমাত্র পটভূমি হিসাবে লেখা। মূল আলোচনায় আসা যাক।
‘‘ভবদহ’’ অনেকেই হয়তো আপনারা নামটি শুনে থাকবেন। ‘‘যশোরের দুঃখ’’ হিসাবে যার পরিচিতি রয়েছে। যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল।এ এলাকার পানি ওঠানামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদ-নদী দিয়ে। তবে পলি পড়ে নদ-নদীগুলো নাব্য হারিয়েছে। এসব নদ-নদী দিয়ে এখন ঠিকমতো পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। এ কারণে পানি আটকা পড়ে নিয়মিত জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।
যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের ভবদহ এলাকায় ১৯৬১ সালে নির্মাণ করা হয় স্লুইসগেট। এর পরই মণিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর এবং খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার মধ্যবর্তী ভবদহের কৃষকরা জলাবদ্ধতার কবলে পড়েন। ১৯৮৮ সাল থেকে স্থায়ীভাবে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। এর মূল কারণ ভবদহের ভাটিতে থাকা নদ-নদীগুলোর নাব্য হারানো।
আমার জানামতে ১৯৯০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় এই সমস্যা থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বরাদ্দের টাকা লুটপাট হওয়ার কারনে ভবদহ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়নাই। যার কারনে প্রতি বছরের কয়েকমাস এই এলাকায় নিয়মিত জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন শুধু অভয়নগরের প্রায় ৩০টি গ্রাম প্লাবিত।বেশির ভাগ ঘরবাড়ি, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, কৃষিজমি ও মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে। সেখানকার হাজার হাজার বাসিন্দা ঘরছাড়া। গবাদি পশু সহ তারা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
অথচ দুঃখজনক বিষয় হলো এই অসহায় জনপদের পাশে বিগত ১৯৮৮ সাল থেকে এই ২০২৪ সাল পর্যন্ত কোন জনপ্রতিনিধি বাস্তবিক পক্ষে দাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা দেখেছি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নানাবিধ সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ঠ এলাকার জনপ্রতিনিধি ত্রানকর্তা হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। সমস্যা সমাধানের জন্য নিজেকে আত্বনিয়োগ করেন। কিন্তু বিগত সময়ে (১৯৮৮ সাল থেকে) এই এলাকার প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ আওয়ামীলীগ থেকে শাহ হাদিউজ্জামান এর পর ২০০১ এ ৪দলীয় জোট সরকারের এম এম আমিন উদ্দিন, ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আওয়ামীলীগের আব্দুল ওহাব,রনজিত কুমার রায় এবং সর্বশেষ ৬মাস জনাব বাবুল ফারাজি এই অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করলেও তারা এই সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
দেশের অন্য অঞ্চলে বন্যা হলে তার একটা প্রচার প্রচারনা লক্ষ করা যায়। যার দরুন সামর্থবান সম্প্রদায় সেই এলাকাতে ত্রান সহ আর্থিক সহযোগীতা নিয়ে তাদের পাশে দাড়ায়। কিন্তু আমার এই অভিভাবকহীন জনপদে একজন দায়িত্বশীল নেতা নেই যিনি এই ভবদহ নামক সমস্যাকে নিজের সমস্যা মনে করে এর সমাধানের জন্য প্রাণপনে চেষ্টা করবেন। অসহায় বন্যাদূর্গত জনসাধারনের পাশে দাড়াবেন। এটি এই জনপদবাসী হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা।
আমরা অভয়নগরবাসী এই ভবদহ নামক দুঃখের ইতি টানতে চাই। যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) এই ব্যাপারে স্থায়ী সমাধানের জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহন করার আহবান জানাচ্ছি। বিশেষত দ্রুত পানি নিষ্কাশন ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণে বিল কপালিয়ায় টিআরএম বাস্তবায়ন ও ভবদহ স্লুইসগেট থেকে শোলগাতী পর্যন্ত নদীতে একটা চ্যানেল করে জরুরি ভিত্তিতে পানি সরানো, আমডাঙ্গা খাল সোজাসুজি খনন করে রাজাপুর খালের সঙ্গে সংযোগ দিতে হবে। এছাড়াও এব্যাপারে অভিজ্ঞ উচ্চতর একটি কমিটি গঠন করে ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধান আমরা অভয়নগরবাসী দেখতে চাই। দেশের অবকাঠামোর উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু বৈষম্যের স্বীকার হয়ে বারবার পিছিয়ে পড়ছি আমরা অভয়নগরবাসী।