সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ০১:৩৩ পূর্বাহ্ন
এক নজরে :
সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির ছোঁয়া: পিআইবিতে মোবাইল সাংবাদিকতায় প্রশিক্ষণ অভয়নগরে জুলাই পুনর্জাগরণে সমাজ গঠনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান ও নারী সমাবেশ অনুষ্ঠিত যশোরে জুমার নামাজে সিইসি ; বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে বিশেষ দোয়া বেনাপোলে বিজিবির অভিযানে বিভিন্ন রকম অবৈধ সামগ্রী আটক বাগআঁচড়া সাতমাইলে মুদিখানা দোকানে, ২ লক্ষ টাকার মালামাল লুট বেনাপোল স্থলবন্দরে বিলাসবহুল মসজিদ ভবনের শুভ উদ্বোধন অভয়নগর প্রেসক্লাবের মাসিক সভা অনুষ্ঠিত বেনাপোল ইমিগ্রেশনে জাতীয় শ্রমিকলীগ নেতা গ্রেফতার সাত মাসে বিজিবির অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যসহ ৩৫ জন আটক সীমান্তে মানবপাচার প্রতিরোধ প্রকল্প পরিদর্শনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব

যশোরের কাজী নাবিল ছিলেন জনতার চোখের আড়ালে : করেছেন জুলুমবাজি, গড়েছেন সম্পদের পাহাড়

দক্ষিণ বাংলা ডেস্ক:
প্রথমবার বিনাভোটে, দ্বিতীয়বার রাতের ভোটে, শেষবার ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে পরপর তিন বার এমপি হন কাজী নাবিল আহমেদ। ১০ বছর ৬মাসের এ জনপ্রতিনিধি বরাবরই ছিলেন জনবিচ্ছিন্ন। তার সাক্ষাত পেয়েছেন এমন সাধারণ মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। দলীয় কর্মীদের দৌঁড় ছিল নাবিলের ব্যক্তিগত সহকারী সুজন সাত্তার পর্যন্ত। সাধারণ মানুষ সাক্ষাতই পেতেন না। তবে জনমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও তাদের টাকা থেকে মোটেও বিচ্ছিন্ন ছিলেন না নাবিল। ডিও নিতে টাকা, নিয়োগে টাকা, স্বাক্ষর করলেই টাকা। টাকা ছাড়া তার কলম চলতই না। ‘ফেল কড়ি মাখো তেল’ এ নিয়মে চলতো নাবিলের রাজত্ব। তার নিয়োগ বাণিজ্যের দর ছিল অন্য এমপিদের দ্বিগুণ। এসব টাকায় যশোরে কিছুই করেননি তিনি। না নিজের, না জনগণের। এসব নানামুখি উৎস থেকে আসা টাকায় তিনি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় গড়েছেন ১৩শ একর জমির কাজী এ্যাস্টেট। পানির দরে কেনা এসব জমির সাথে মিশে আছে অসংখ্য মানুষের চোখের জল। তার নিরব অত্যাচারের শিকার হাজারো মানুষের কান্না শুকাবার নয়।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিতে প্রতাপশালী শাহীন চাকলাদারের সামনে শক্ত প্রাচীর হয়ে ছিলেন কাজী নাবিল। তিনি দলকে দু’ভাগে ভাগ করে রেখেছিলেন। এক ভাগ শাহিন চাকলাদারের, অন্যভাগে নাবিলের নেতৃত্বে পরিচালিত হতো। প্রথম দিকে তার সঙ্গী ছিল আওয়ামী লীগের কতিপয় বঞ্চিত নেতা। আর শাহীন চাকলাদারের নিয়ন্ত্রণে ছিল অপরাধ সাম্রাজ্য। শাহীন চাকলাদার সাম্রাজ্য নঢ়বড়ে করে চিহ্নিত সন্ত্রাসী টাক মিলন, বিপুল, শাহরুল তার বুকে ঠাঁই পায়। নাবিলের আশ্রয় প্রশয়ে বিপুল, টাক মিলন হয়ে ওঠেন আরো অপ্রতিরোধ্য। নাবিলের ইন্ধনে বিপুল-মিলনের আগ্রাসনে খোদ শাহীন চাকলাদারই হয়ে যান যশোর ছাড়া। যশোর শহর চলতো নাবিলের একক নিয়ন্ত্রণে। শুধু সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের নয়, প্রশাসনিক প্রভাব ও অবৈধ অর্থের নিয়ন্ত্রণও চলে আসে নাবিলের হাতে। তবে যশোরে দৃশ্যমান কিছুই নেই তার।

চলতি বছরের ১৬ আগস্ট শুক্রবার বিকেলে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলতলা উপজেলার চৌরাস্তা বাজারের মানববন্ধন করে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। তাদের অভিযোগ সাবেক সংসদ সদস্য ও জেমকন লিমিটেড এবং কাজী এন্ড কাজী টি এ্যাস্টেটের সত্ত্বাধিকারী কাজী নাবিল অবৈধভাবে তাদের জমি জমি দখলে রেখেছে। হুমকি ও মিথ্যা মামলায় শত শত মানুষকে ভুমি ও গৃহহীন করেছেন কাজী নাবিল। কাজী নাবিল হাজার হাজার একর জমি কিনে এই অঞ্চলে চা বাগান, চা কারখানাসহ বেশ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও রিসোর্ট স্থাপন করেছেন। তার দখলে রয়েছে সরকারি জমি ও ডাহুক নদী। যারা জমি দিতে চাননি এমন হাজারো মানুষকে আসামি করে ফৌজদারী এবং সিভিল আদালতে প্রায় ৫ শতাধিক মামলা দায়ের করেছেন। মানববন্ধনে নেতৃত্বদানকারীরা জানায়, তেঁতুলিয়ায় প্রায় ১ হাজার ৩শ একর জমিতে কাজী নাবিলের চা বাগান রয়েছে। আনন্দ ধারা নামে একটি রিসোর্টও রয়েছে। এছাড়া পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলায় চা বাগান, সদর উপজেলায় পোল ফ্যাক্টরি, বোদা উপজেলায় জুট মিল রয়েছে।

জানা যায়, ২০২০ সালের দিকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার দর্জিপাড়া, শালবাহান ইউনিয়নের রওশনপুরসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় জমি কিনে চা চাষ শুরু করে জেমকন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা কাজী শাহেদ আহমেদ। গড়ে তোলেন হয় কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তবে দীর্ঘ দিন পরে জেমকন গ্রুপের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ও কাজী নাবিল আহমেদ এমপি থাকাকালে মানুষের জমি দখলের মহোৎসব চলে।

এত অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া স্বত্তেও কাজী নাবিল নিজেকে ঋণগ্রস্ত অভাবী হিসেবে পরিচয় করিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনে তার দাখিলকৃত একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আয় ও অস্থাবর সম্পত্তি বাড়লেও ঋণে জর্জরিত কাজী নাবিল আহমেদ। ৫ বছরে তিনি ব্যবসায়ীক কারণে ৩শ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। তার হিসেবে মোট ঋণ ৯১৯ কোটি ২৭ লাখ ৫৪ হাজার ৬৬১ টাকা। একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তার বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন ১ কোটি ২৬ লাখ ২০ হাজার ৪২৯ টাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দেয়া হলফনামা দেখান ১৪ কোটি ৩৮ লাখ ৪৪ হাজার ৯৮১ টাকা। নিজের অস্থাবর সম্পত্তি দেখানো ছিল ২০ কোটি ৩৪ লাখ ৯৪ হাজার ৮৩৯ টাকার, স্ত্রীর ছিল ৬ কোটি ৯৭ লাখ ১৮ হাজার ৮৭০ টাকা, সন্তানের সঞ্চয়পত্র ছিল ১৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৬৪ টাকা। এছাড়া স্বর্ণ ছিল ৮৮.২০ তোলা। যার মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি।

দ্বাদশ সংসদের হলফনামায় দেখা যায় কাজী নাবিলের নিজের অস্থাবর সম্পদ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ কোটি ১৬ লাখ ৮০ হাজার ১৬৫ টাকা, স্ত্রীর অস্থাবর সম্পাদ বেড়ে হয় ৯ কোটি ২২ লাখ ৬৪ হাজার ৪২৭ টাকা ও সন্তানের সঞ্চয়পত্র বেড়ে হয় ৭৪ লাখ ৫৭ হাজার ৩৬৩ টাকা। স্বর্ণ ৮৮.২০ তোলা। একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় কাজী নাবিলের স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে অকৃষি জমি ছিলো ২ কোটি ২৩ লাখ ৩৭ হাজার ১০৪ টাকার ও ৪ কোটি ৪৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮৬৫ টাকা মূল্যের একটি এপার্টমেন্ট ছিল।

স্ত্রীর নামে ছিল ২ কোটি ১০ হাজার ৭৬৩ টাকার একটি বাড়ি ও যৌথ মালিকানায় ২ কোটি ২৯ লাখ ২৪ হাজার টাকার সম্পদ ছিল। দ্বাদশ নির্বাচনের হলফনামায় নিজের স্থাবর সম্পত্তি কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ৯৯ লাখ ৭৬ হাজার ৩৩৬ টাকা। কাজী নাবিল আহমেদ তার ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের নামে ৬২৬ কোটি ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ২৯৬ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন বলে একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় উলে¬খ করেছিলেন। সে ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১৯ কোটি ২৭ লাখ ৫৪ হাজার ৬৬১ টাকায়। স্বস্বীকৃতিতেই কাজী নাবিল ৫১ কোটি ৬৬ লাখ ৮০ হাজার ২২৬ টাকার সম্পদের মালিক।

কাজী নাবিল শুধু সম্পদ গড়েননি। জেলায় আধিপত্যের লড়াইয়ে গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। এ বাহিনীর ছিল নিজস্ব টর্চারসেল। এসব সেলে নির্যাতন, মাদক বিক্রি, হুমকি, ভয়ভীতি, চাঁদাবাজি করা হতো। কাজী নাবিল আহমেদের অনুসারী পৌর কাউন্সিলর শেখ জাহিদ হোসেন মিলন ওরফে টাক মিলন ও আনোয়ার হোসেন বিপুলের নেতৃত্বে চলতো নির্যাতন। এ বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনে চলতি বছরের মে মাসে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনের আগে যশোরের ঘটে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি।

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসেই যশোরে খুন হয় ১২ জন। একই সঙ্গে বাড়ে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতায় চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মাদক কারবার। কাজী নাবিলের প্রশ্রয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা এসব ঘটনা ঘটায়। ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে যশোর পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জেলা যুবলীগের প্রচার সম্পাদক জাহিদ হোসেন মিলনকে তিন সহযোগীসহ মদ্যপান অবস্থায় গ্রেফতার করে পুলিশ।

একই দিন দুপুরে সন্ত্রাসী ও যুবলীগ নেতা মেহবুব রহমান ম্যানসেলের নেতৃত্বে যশোর সরকারি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে দ্বিতীয় দফায় হানা দেয়ার ঘটনায় মামলা হলে ম্যানসেলসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই সময় শহরের বিতর্কিত জনপ্রতিনিধিরা ব্যক্তিগত কার্যালয়েও বসতেন না। তবে সদর উপজেলা সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল এমপির বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছিল। টাক মিলন, বিপুল ম্যানসেল, সাহাজাহান শিপলু, কাউন্সিলর হিটার নয়ন, শীর্ষ সন্ত্রাসী ফিঙ্গে লিটনের ভাই কাউন্সিলর রিপনসহ অনেকেই নাবিলের সন্ত্রাস কর্মকান্ড ও অর্থ হাতিয়ে নেয়ার কারবারের সাথে জড়িত ছিল বলে বরাবরই অভিযোগ আছে।

৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর কাজী নাবিল অন্যান্য এমপিদের মত রয়েছেন আত্মগোপনে। তার সাঙ্গপাঙ্গরা গা ঢাকা দিয়েছে। তবে বাহিনী প্রধানরা গা ঢাকা দিলেও চ্যালাচমুন্ডরা প্রকাশেই ঘুরছেন বলেই স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন। আর পুরাতন কসবার কাজী বাড়ির প্রধান ফটক বন্ধ হয়ে আছে।
সূত্র : দৈনিক লোকসমাজ



Our Like Page